চার বছরের উপরে অষ্ট্রেলিয়াতে আছি। আমাদের ছয় ঋতুর বদলে এখানে চার ঋতু। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হল গ্রীষ্ম। মার্চ থেকে মে এখানকার শরৎ কাল। এর পরের তিন মাস হল শীত আর সেপ্টেম্বর থেকে শুরু বসন্ত। এ দেশে বর্ষা আর হেমন্ত কাল বলে কিছু নেই। প্রথম প্রথম কেমন অদ্ভুত লাগত। এখানে আসার কিছুদিন পরে দেশে ফোন করেছি একদিন। দাদী হয়তো চাদর জড়িয়ে পৌষের শীতে ঠকঠকিয়ে কেঁপে ফোন ধরেছেন।
প্রথমেই প্রশ্ন, কিরে রঞ্জু, তোদের ওখানে শীত কেমন পড়েছে? সাথে সাথে উপদেশ – সাবধানে থাকিস। তোর তো আবার টনসিলের সমস্যা।
আমি বলি, শীত কোথায় দাদী। আমাদের এখানে তো এখন গরম কাল। গরমে গায়ের চামড়া পুড়ে কাল হয়ে গেছে।
বলিস কিরে? সঞ্জু (আমার ছোট ভাই) ফোন করলো লন্ডন থেকে, বরফ পড়ে পথ ঘাট সাদা হয়ে গেছে। তিতলী (আমার মামাত বোন) সেদিন ফোন করে বলল নিউ জার্সি থেকে; বরফ পড়ে রাস্তা ঘাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। তামাম দুনিয়ায় শীত কাল আর তোদের হল উলটা গরম। বড় তাজ্জবের কথা!
আমি বলি, দাদী, তোমরা, সঞ্জু আর তিতলীরা – সবাই থাক উত্তর গোলার্ধে। আর আমরা থাকি তার উলটো দিকে। তাই, আমাদের যখন শীত তোমাদের তখন গরম কাল।
জুনের শেষ। আমি শুধু দিন গুনি – কখন শীত কালটা শেষ হবে। অফিসিয়ালি আগস্টের শেষে শীত কালের ইতি হলেও, শীতের প্রকোপ নভেম্বরের আগে শেষ হয় না। আর আমার ভোগান্তিও কমে না। ঘুম থেকে উঠলাম সকাল সাড়ে ছটায়; বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সূর্য উঠতে এখনো আধা ঘণ্টার মত বাকী। উনি উঠুন বা না উঠুন, তার জন্য তো আর বিশ্বসংসার আটকে থাকে না। সরকারী অফিসে একটা ছোটখাটো কাজ করি। অফিসে সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছাতে হয়। নিজের গাড়ী করে ট্রেন ষ্টেশনে গিয়ে গাড়ী রাখি। সেখান থেকে ট্রেন ধরে সিডনী সেন্ট্রালে এসে নামি। তার পর আবার মিনিট দশেকের হাটা পথ। তাই, সকাল সাতটার মধ্যে বাসা থেকে বেরুতে না পারলে অফিসে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যায়। গিন্নির অফিস বাসার কাছে। আমি যাবার পর, সে ধীরে সুস্থে কন্যা মুনাকে ওর স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, চলে যায় ওর অফিসে।
আমি ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে নাস্তা করার আগে ঘরের বাইরে আসি দৈনিক পত্রিকাটা তুলে নেবার জন্য। আমাদের এলাকায় রাত সাড়ে পাঁচ থেকে ছটার মধ্যে পত্রিকা দেবার লোক গাড়ী করে এসে বাড়ীতে বাড়ীতে প্লাস্টিকে মোড়া পত্রিকা ছুড়ে ফেলে দিয়ে যায়। অফিসে যাবার আগে, নাস্তা করার সাথে সাথে আমি পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেই। দেশ থেকে বয়ে আনা অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারলাম না। ভোরের আলো ফুটে উঠছে। দুরের ব্লু-মাউন্টেনের দিকে দৃষ্টি ফেলি আমি। কিন্তু কুয়াসার ঘন চাদর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। শেষ রাতের আকাশে এখানে সেখানে দু-চারটা তারা ফুটে আছে। বাড়ীর সামনের লনে সবুজ ঘাসের উপর ফ্রষ্ট। আমাদের এখানে বরফ পড়ে না। তবে, মাঝে মাঝে ফ্রষ্ট হয়। ঘাসের উপর বরফের মতই পাতলা সাদা একটা আস্তরণ। মনে হয়, ঘাসে যেন কেউ দুধ ঢেলে দিয়ে গেছে।
মৃদু বাতাস বইছে। ঠাণ্ডায় আমার হাত দুটো প্রায় অসাড় হয়ে যায়। আমি ফুটপাথ থেকে পত্রিকার বান্ডিল তুলে দ্রুত ঘরের দিকে এগুতেই লনের এক কোনে লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছটার উপর দৃষ্টি পড়ে যায়। বছর দেড়েক আগে এক ছুটিতে উত্তর কুইন্সল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে, রাস্তার পাশের একটা গাছে লাল ফুলের সমারোহ গিন্নী চৈতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে মহা উৎসাহে বলে উঠে, দেখ দেখ, কৃষ্ণচূড়া। আমার বিশ্বাস হয় না। তিন বছরের মত অষ্ট্রেলিয়া আছি, কখনো কৃষ্ণচূড়া চোখে পড়ে নি। তবে, কৃষ্ণচূড়ার মতই জ্যাকারান্ডা নামের আরেকটা ফুল দেখেছি। ফুলের গাছটাও কৃষ্ণচূড়ার মতই বড়; তবে, ফুলের রঙটা লাল না হয়ে বেগুনী। কাছে গিয়ে দেখি, ফুলটা কৃষ্ণচূড়াই বটে।
চৈতী আবদার করে, চল না, একটা কৃষ্ণচূড়ার চারা নিয়ে যাই। আমাদের সিডনীর বাসায় লাগাব।
দেখ, নর্থ কুইন্সল্যান্ড হচ্ছে উষ্ণ এলাকা। তাই এখানে কৃষ্ণচূড়া জন্মাতে পারে। সিডনীর ঠাণ্ডায় এ গাছ বাঁচবে না। আমি ওকে বুঝাই।
না আমি ভাল করে যত্ন করব। নাওনা একটা চারা, প্লিজ।
আমি ওর কথা ফেলতে পারি না। নার্সারি থেকে একটা কৃষ্ণচূড়ার চারা কিনে নিয়ে আসি ফেরার পথে। দেখতে দেখতে দেড়টা বছর কেটে গেল। চারাটা যখন লাগাই, তখন ছিল গরম কাল। লাগানোর কিছুদিন পর, চৈতীর ঐকান্তিক যত্নে ওটা বেশ বেড়ে উঠল। নতুন পাতা গজাল। কিন্তু মাস চারেক পর, শীত নামতেই চারাটা মরে মরে অবস্থা। ওটার অবস্থা কাহিল হয় আর চৈতীর মুখটাও শুকাতে থাকে। অনেক কষ্টে, ঢেকে ঢুকে ওটাকে শীতটা পার করানো হল। শীতের শেষে টিকে থাকলো একটা কাঠি শুধু। ভাবলাম মরেই গেছে চারাটা। কিন্তু মাস খানেক পর, কোন এক অলৌকিক শক্তিতে কাঠিটায় পাতা এলো আবার। মাস ছয়েকের মধ্যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো চারাটা।
এখন আরেক শীত কাল। শীতের শুরু থেকেই চারাটার পাতা গুলো আবার কাল হয়ে কোঁকড়াতে থাকে ঠাণ্ডায়। জুনের শেষে দু চারটা পাতা টিকে থাকে শুধু। আমি চারাটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। উষ্ণ অঞ্চলের চারাটার শীত অঞ্চলের এই মাটিতে বেঁচে থাকার কি প্রাণপণ প্রচেষ্টা।
হঠাৎ করে চারাটার মৃতপ্রায় পাতায় নিজের ছায়াকে দেখতে পাই আমি। অনুভব করি আত্মার আত্মীয়তা। চারাগাছটা যেন আমি। নিজকে অচেনা মাটিতে প্রতিষ্ঠার কি প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪